ডিপ্রেশন কী? জানুন আদ্যোপান্ত!

ডিপ্রেশন খুবই কমন কিন্তু মারাত্মক একধরণের মানসিক ব্যাধি যা আপনার অনুভূতি, চিন্তা-চেতনা ও কাজকর্মের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমরা অনেক সময় দুঃখবোধ(Sadness)ও বিষণ্ণতাকে(Depression)এক বলে মনে করি। এ দুটো কিন্তু এক নয়। দুঃখবোধ হলো সাময়িক মন খারাপ যা অল্প কিছু সময় পরেই ঠিক হয়ে যায়। এর জন্য কোন চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে, ডিপ্রেশন দীর্ঘকালীন সমস্যা। যা থেকে মুক্তি পাবার জন্য উপযুক্ত চিকিৎসার ও পরামর্শের প্রয়োজন হয়ে থাকে।

ডিপ্রেশনের লক্ষণ :

বিষণ্ণতা একটি আবেগজনিত মানসিক সমস্যা। দুঃখবোধের মতো সাধারণ আবেগ যখন অযৌক্তিক, তীব্র ও দীর্ঘ সময়ব্যাপী কোনো ব্যক্তিকে ঘিরে থেকে তার স্বাভাবিক জীবনযাপন, কর্মতৎপরতা ও পারস্পরিক সম্পর্ককে বাধাগ্রস্ত করে, তখন সেটাকে বলা হয় বিষণ্নতা।
১. কমপক্ষে দুই সপ্তাহজুড়ে দিনের বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকা ও কোনো কিছু করতে ভালো না লাগা।
২. মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, হঠাৎ রেগে যাওয়া।
৩. আগে যেসব কাজ বা বিনোদন করতে ভালো লাগত এখন সেগুলো ভালো না লাগা।
৪.মনোযোগ কমে যাওয়া।
৫. ক্লান্তি বোধ করা।
৬. ঘুমের সমস্যা (যেমন—খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যাওয় বা ঘুম না হওয়া অথবা বেশি ঘুম হওয়া)।
৭. রুচির সমস্যা (যেমন—খেতে ইচ্ছে না করা, খিদে না থাকা বা বেশি বেশি খাওয়া)।
৮.যৌনস্পৃহা কমে যাওয়া।
৯.মনোযোগ কমে যাওয়া, সাধারণ বিষয় ভুলে যাওয়া।
১০. সব সময় মৃত্যুর চিন্তা করা, নিজেকে অপরাধী ভাবা, আত্মহত্যার চিন্তা ও চেষ্টা করা ইত্যাদি।
১১. নিজেকে খুব ছোট ও অপাঙেক্তয় মনে হতে পারে, উৎসাহ-উদ্দীপনা কমে যায়, সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার প্রবণতা কমে যায়।


এ ছাড়া কিছু শারীরিক সমস্যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যেমন মাথাব্যথা, মাথায় অস্বস্তি, মাথা-শরীর-হাত-পা জ্বালা করা, গলার কাছে কিছু আটকে থাকা, শরীরব্যথা, ঘাড়ব্যথা, গিঁটে গিঁটে ব্যথা, বুক জ্বালা, বুকব্যথা, নিঃশ্বাসে কষ্ট ইত্যাদি। কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এসব শারীরিক সমস্যার কারণ পাওয়া যায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আচরণের অস্বাভাবিকতাও দেখা দিতে পারে।

যে কোন ধরনের মানসিক সমস্যায় আপনি ফোন কলে, চ্যাটে বা সরাসরি আমাদের কাউন্সেলিং সেন্টারে এসে সাইকোলজিস্টের কাছে কাউন্সেলিং নিতে পারবেন। ডিপ্রেশন কাউন্সেলিং সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন – Depression Counselling in Dhaka

ডিপ্রেশন কেন হয়?

ডিপ্রেশন একটি জটিল রোগ। কেন এ রোগ হয় নির্দিষ্ট করে কারো পক্ষেই তা বলা সম্ভব না। তবে অনেকের ক্ষেত্রেই কিছু কমন কারণ থাকে যার জন্য এ রোগের উৎপত্তি হতে পারে।


১. অপমানবোধ

মানসিক বা শারীরিকভাবে অবমাননার স্বীকার হলে অনেকে ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়।

২. নিরাপত্তাহীনতা বা একাকীত্ব

সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেকে বিষণ্নতার স্বীকার হয়। তাছাড়া, বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধব বা অন্যান্য কাছের মানুষদের সাথে সম্পর্কহীনতা বা মতবিরোধ থেকেও অনেকে বিষণ্ণতায় ভুগে থাকে।

৩. মৃত্যুশোক

কাছের মানুষের মৃত্যু অনেকের ক্ষেত্রে বিষণ্ণতার ঝুঁকি বাড়ায়।

৪. বংশগত প্রভাব

পরিবারে কারো ডিপ্রেশন থাকলে তা অন্যদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

৫. জীবন পদ্ধতিতে বড় ধরণের পরিবর্তন

জীবনে বড় কোন পরিবর্তন ঘটলে তা থেকে অনেকে বিষণ্ণতায় ভুগে। চাকরি হারালে, অবসরে গেলে, আয় কমে গেলে, জায়গা পরিবর্তন করলে, বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে, এমনকি, নতুন বিয়ে করলেও অনেকে ডিপ্রেশনের শিকার হয়।

৬. বড় কোন রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

বড় ধরণের কোন রোগ থাকলে রোগী ডিপ্রেশনের শিকার হতে পারে।

৭. ঔষধের প্রভাব

নির্দিষ্ট কিছু ঔষধ সেবনের ফলেও কেউ কেউ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়। যেমন, ব্রণের চিকিৎসায় ব্যবহৃত আইসোট্রেটিনিয়ন বা অ্যান্টিভাইরাল “ইন্টারফেরন-আলফা” জাতীয় ঔষধ সেবনেও অনেকে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়।
এছাড়াও আরও বিভিন্ন কারণে মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগে থাকে। ব্যক্তিভেদে বিষণ্ণতার কারণে পার্থক্য দেখা যায়।

কী করে বুঝবেন যে আপনি বিষণ্ণতায় ভুগছেন?

১. কাজের প্রতি অনীহা

আপনার শখের কাজগুলোতে আপনি ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে শুরু করবেন। কোন কাজেই উৎসাহ পাবেন না। সারাদিন শুয়ে-বসে থাকাকেই মনে হবে সবচেয়ে সহজ কাজ এবং এর বাইরে সকল কাজকেই বোঝা মনে হবে। এক সময় যে কাজে খুব আনন্দ পেতেন ডিপ্রেসশড্ হয়ে যাবার পর সে কাজেও কোন আগ্রহই খুঁজে পাবেন না।

২. খাদ্যাভাসে পরিবর্তন

ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হলে আপনার রেগুলার খাদ্যাভাসে পরিবর্তন দেখা দেবে। হয় আপনি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খাবেন আর নয়তো আপনার খাবারে অরুচি দেখা দেবে। এ ফলে আপনার ওজন দ্রুত বাড়বে বা কমতে থাকবে যা আপনার শরীরে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি করবে।

৩. দীর্ঘকালীন অনিদ্রা

দীর্ঘ সময় ধরে অনিদ্রা বিষণ্ণতার একটি লক্ষণ। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যারা বিষণ্ণতায় ভুগছেন তাদের আশি ভাগেরই অনিদ্রার সমস্যা রয়েছে। যেসব রোগীর দীর্ঘকালীন অনিদ্রাজনিত সমস্যা রয়েছে তাদের বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবতা তাদের চেয়ে তিন গুণ বেশি যাদের এ সমস্যা নেই। অনেক চিকিৎসকরা বিশ্বাস করেন, অনিদ্রা রোগের যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে বিষণ্ণতা রোগের তীব্রতা প্রশমন করা সম্ভব। যদি আপনার দীর্ঘকালীন নিদ্রাহীনতাজনিত সমস্যা থেকে থাকে, তবে আপনি হয়তবা বিষণ্ণতা রোগে ভুগছেন।

৪. অবসাদ

বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হলে অবসাদ আপনাকে গ্রাস করবে। তাই যখন দেখবেন আপনি অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন, কোন কিছুতেই উৎসাহ পাচ্ছেন না তখন বুঝবেন আপনি একজন ডিপ্রেশনের রোগী।

৫. নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাওয়া

বিষণ্ণতার কারণে আপনি নিজেকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে ফেলতে থাকবেন। পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গ ভালো লাগবে না। সামাজিকতা অনেক সময় অসহনীয় হয়ে দেখা দেবে। একাকীত্ব ঘিরে ফেলবে আপনাকে যা আপনার অসুস্থতা আরো বাড়িয়ে তুলবে।

৬. সবকিছুতেই মনোযোগের অভাব

বিষণ্ণতার ফলে আপনি একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে যেতে থাকবেন। কোন কিছুতেই ঠিকভাবে মনোনিবেশ করতে পারবেন না। অন্যদের কথা মন দিয়ে শুনতে পারবেন না বা কোন আলেচনায় অংশ নিতে পারবেন না।

৭. সব বিষয়ে নেতিবাচক মনোভাব

দুঃখবোধ, আশাহীনতা ও হতাশা আপনাকে ঘিরে ফেলবে। সবকিছুতেই নেতিবাচক মনোভাব দেখা দিতে থাকবে।

৮. মাথা ব্যথা ও গাস্ট্রিকের সমস্যা

নিয়মিত মাথা ব্যথা ও হজমে সমস্যাও ডিপ্রেশনের লক্ষণ।

ডিপ্রেশন কি ভাল হয়?

ডিপ্রেশন চিকিত্সাযোগ্য, এবং অনেক লোক বিভিন্ন থেরাপি এবং কাউন্সেলিং এর মাধ্যমে তাদের উপসর্গ থেকে মুক্তি পায়। যদিও কিছু ব্যক্তি তাদের বিষণ্নতাজনিত উপসর্গগুলির সম্পূর্ণ সমাধান অনুভব করতে পারে, অন্যরা দেখতে পারে যে চিকিত্সার মাধ্যমে অবস্থা আরও নিয়ন্ত্রণযোগ্য হয়ে ওঠে, যার ফলে জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। এটা বোঝা অত্যাবশ্যক যে ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা একটি জটিল মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা, এবং কিছু ব্যক্তি তাদের জীবদ্দশায় বারবার তা অনুভব করতে পারে। প্রাথমিক সনাক্তকরণ, পেশাদার সাহায্য চাওয়া, এবং ধারাবাহিক চিকিত্সার সাহায্যে ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

ডিপ্রেশনের চিকিৎসা

নিয়মিত ব্যায়াম এবং সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলিং ডিপ্রেশনের প্রধান চিকিৎসা। সাইকোথেরাপি, ওষুধ, জীবনযাত্রার পরিবর্তন, সহায়তা গ্রুপ, ইলেক্ট্রোকনভালসিভ থেরাপি (ইসিটি), এবং ট্রান্সক্রানিয়াল ম্যাগনেটিক স্টিমুলেশন (টিএমএস) সহ বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমেও বিষণ্নতার চিকিৎসা করা যেতে পারে। সাইকোথেরাপি, যেমন জ্ঞানীয়-আচরণগত থেরাপি (সিবিটি) এবং আন্তঃব্যক্তিক থেরাপি (আইপিটি), ব্যক্তিদের তাদের আবেগ এবং চিন্তাভাবনার সাথে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। এসএসআরআই এবং এসএনআরআই-এর মতো অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধ মস্তিষ্কের রাসায়নিকের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে। লাইফস্টাইল পরিবর্তন এবং সুষম খাদ্য ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন আনতে পারে। ECT গুরুতর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় যখন অন্যান্য চিকিত্সা ব্যর্থ হয়, যখন TMS মস্তিষ্কের কোষগুলিকে আক্রমণাত্মকভাবে উদ্দীপিত করে। পেশাদার সাহায্য চাওয়া এবং একটি ব্যক্তিগত পরিকল্পনা মেনে চলা বিষণ্নতা থেকে বাঁচার জন্য অপরিহার্য।